রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকেলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ফোন করেছিলেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তির জন্য রাশিয়ার সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো তুলে ধরেছেন।

এরদোয়ানের প্রধান উপদেষ্টা ও মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন ফোনকলের সময় প্রেসিডেন্টের পাশে ছিলেন। তার মতে, রাশিয়ার দাবি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। তিনি বলেন, প্রথম চারটি দাবি পূরণ করা ইউক্রেনের পক্ষে খুব কঠিন নয়।

এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো ইউক্রেনের এটা স্বীকার করা যে এর নিরপেক্ষ থাকা উচিত এবং ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করা উচিত নয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

এই বিভাগের অন্যান্য দাবিগুলোর বেশির ভাগই নিছক রুশ পক্ষের মুখ রাখার জন্য যুক্ত করা বলে মনে করা হচ্ছে।

ইউক্রেনকে একটি ‘নিরস্ত্রীকরণ’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে এটি রাশিয়ার জন্য হুমকি না হয়। ইউক্রেনে রুশ ভাষার জন্য সুরক্ষা থাকতে হবে। আর নাৎসিমুক্তকরণও অন্যতম শর্ত।

এটি জেলেনস্কির জন্য খুব আপত্তিকর হবে। কারণ তিনি নিজে ইহুদি এবং তার কিছু আত্মীয় নাৎসিদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞে মারা গিয়েছিল। তবে তুরস্ক মনে করে, জেলেনস্কির পক্ষে এটি মেনে নেওয়া যথেষ্টই সহজ হবে। সম্ভবত সব ধরনের নব্য-নাৎসিবাদের নিন্দা এবং তাদের দমন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়াই যথেষ্ট হবে। রাশিয়ার শর্তের দ্বিতীয় বিভাগটিতে সমস্যা হতে পারে। এরদোয়ানকে ফোন কলে পুতিন বলেছিলেন, এই বিষয়গুলোতে মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য তার এবং জেলেনস্কির মধ্যে মুখোমুখি আলোচনার প্রয়োজন হবে।
জেলেনস্কি ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার জন্য প্রস্তুত। এরদোয়ানের উপদেষ্টা কালিন এই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব কম সুনির্দিষ্ট কথা বলেছেন। তিনি শুধু বলেছেন, ওই শর্তগুলো পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসের পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত। দনবাসের কিছু অংশ ইতিমধ্যে ইউক্রেন থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাশিয়া ওই অঞ্চলের রুশ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ক্রিমিয়ার পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়েছে।

তুর্কি কর্মকর্তা ইব্রাহিম কালিন বিশদ না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া ইউক্রেনীয় সরকারের কাছে পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার দাবি করবে। এটি বিতর্কিত হবে। আরেকটি অনুমান হচ্ছে, পুতিন ক্রিমিয়াকে এখন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে মেনে নেওয়ার দাবি করেছেন। এটি ইউক্রেনের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন হবে।

ঐতিহাসিক সূত্রের কথা বলে রাশিয়া ২০১৪ সালে সেনা পাঠিয়ে ক্রিমিয়াকে নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিয়েছিল।

রাশিয়ার ক্রিমিয়ার ওপর মালিকানার কোনো আইনি অধিকার না থাকলেও উপদ্বীপটি ইতিমধ্যেই কার্যত তার নিয়ণ্ত্রণে চলে গেছে। অথচ দেশটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যাতে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। তবে সেটি ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার আগের কথা।

এরপরও মনে করা হচ্ছে পুতিনের দাবিগুলো অনেকের আশঙ্কার মতো কঠিন নয়। রাশিয়া ইউক্রেনে যে সহিংসতা, রক্তপাত এবং ধ্বংসলীলা ডেকে এনেছে তার তুলনায় তো খুব কমই।
রুশ মিডিয়ার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে, এগুলোকে একটি বড় বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করা পুতিন এবং তার সহযোগীদের পক্ষে খুব কঠিন হওয়া উচিত নয়। তবে ইউক্রেনের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হতে চলেছে।

চুক্তির সূক্ষ্ম বিষয়গুলো অত্যন্ত যত্নসহকারে সাজানো না হলে পুতিন বা তার উত্তরসূরিরা আগামীতেও ইউক্রেনকে আবার আক্রমণ করার অজুহাত হিসেবে তা ব্যবহার করতে পারেন।
যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ হলেও একটি শান্তিচুক্তি হতে অনেক সময় লাগতে পারে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেন ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়া যে শহরগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করেছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণ করতে অনেক সময় লাগবে। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লাখ লাখ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন করা হবে আরেক কঠিন কাজ।

আর পুতিনের নিজের বিষয়ে কী হবে? বলাবলি হচ্ছে, তিনি অসুস্থ। এমনকি সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন। ফোনালাপের সময় তা ইব্রাহিম কালিনের কাছে কি কিছু অদ্ভুত ঠেকেছে? ‘মোটেও না। পুতিন কথাবার্তায় ছিলেন সুস্পষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত। ’ বলেন কালিন।

তারপরও এ কথা বলতে হবে, পুতিন যদি ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তিকে নব্য নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে গৌরবময় বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হনও, দেশে তার অবস্থান অবশ্যই দুর্বল হবে। আরো বেশিসংখ্যক নাগরিক বুঝতে পারবে, তিনি বাজেভাবে সীমা অতিক্রম করেছেন। নিহত বা বন্দি রুশ সেনাদের কাহিনিও ইতিমধ্যেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

সূত্র : বিবিসি।